গাজা যুদ্ধবিরতি: রক্তস্নাত গাজায় কি ফিরবে শান্তি? নাকি সব আলোচনা ব্যর্থ?

গাজা যুদ্ধবিরতির সর্বশেষ খবর ও গভীর বিশ্লেষণ। কাতারে চলমান আলোচনা, মার্কিন প্রস্তাব, হামাসের দাবি এবং ইসরায়েলের অনড় অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। শান্তির পথ কি খুলবে?

Jul 8, 2025 - 18:14
 0
গাজা যুদ্ধবিরতি: রক্তস্নাত গাজায় কি ফিরবে শান্তি? নাকি সব আলোচনা ব্যর্থ?
গাজা যুদ্ধবিরতি: রক্তস্নাত গাজা । ছবি :আল-জাজিরা

ভূমিকা: গাজার আকাশে কি আদৌ শান্তির সূর্য উঠবে?

আবারও আলোচনার টেবিলে বসেছে ইসরায়েল ও হামাস, কিন্তু গাজার আকাশে কি আদৌ শান্তির সূর্য উঠবে? কাতারের বিলাসবহুল হোটেলে যখন কূটনীতির জটিল খেলা চলছে, তখন গাজার প্রতি বর্গমিটার মাটি ভিজছে রক্তে, বাতাসে ভাসছে লাশের গন্ধ আর ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না। কয়েক মাস ধরে চলা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে একটি যুদ্ধবিরতির জন্য আকুতি জানাচ্ছে পুরো বিশ্ব। কিন্তু এই আলোচনা কি সত্যিই রক্তপাত থামানোর জন্য, নাকি এটি সময়ের খেলা মাত্র?

এই আর্টিকেলে আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনার সর্বশেষ পরিস্থিতি। আমরা জানব, কাতারে চলমান আলোচনার টেবিলে কী আছে, দুই পক্ষের মূল শর্তগুলো কী এবং কেন সেই শর্তগুলো শান্তির পথে হিমালয় সমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিশর, কাতার ও আমেরিকার মধ্যস্থতা, নেতানিয়াহুর গোপন পরিকল্পনা এবং হামাসের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে শুরু করে এই আলোচনার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ—প্রতিটি বিষয় আমরা তুলে ধরব সহজ বাংলায়।

প্রেক্ষাপট: কেন এই যুদ্ধবিরতির আলোচনা?

এই আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হলে আমাদের সংঘাতের গভীরে যেতে হবে। ৭ই অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় যে সামরিক অভিযান শুরু করে, তা দ্রুতই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নেয়। কিন্তু ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মূল কারণ শুধু একটি ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়।

এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কয়েক দশক পুরনো। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস হলো ফিলিস্তিনিদের ভূমি হারানোর ইতিহাস, কয়েক প্রজন্ম ধরে চলা দখলদারিত্ব এবং স্বাধীনতার স্বপ্নের অপমৃত্যুর ইতিহাস। গাজা উপত্যকাকে বছরের পর বছর ধরে একটি উন্মুক্ত কারাগার বানিয়ে রাখা এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বসতি স্থাপন—এই সবকিছুই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে, তার চরম বহিঃপ্রকাশ ছিল ৭ই অক্টোবরের ঘটনা।

আজ এই যুদ্ধবিরতি কেন প্রয়োজন, তার উত্তর দেবে গাজার ধ্বংসস্তূপ। গাজার মানবিক সংকট ইতিহাসের সব ভয়াবহতাকে হার মানিয়েছে। ৩০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত, যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। হাসপাতালগুলো পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, স্কুলগুলো শরণার্থী শিবির। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাবে মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। শিশুরা অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিই যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে অপরিহার্য করে তুলেছে, কারণ প্রতিটি মুহূর্তের বিলম্বের অর্থ আরও একটি নিষ্পাপ প্রাণের সমাপ্তি।

চলমান আলোচনা: টেবিলে কী আছে?

সবার চোখ এখন মধ্যপ্রাচ্যের ছোট দেশ কাতারের দিকে। কিন্তু কাতারে যুদ্ধবিরতি আলোচনার কি হলো? দোহায় মিশর, কাতার এবং আমেরিকার মধ্যস্থতায় যে আলোচনা চলছে, তা মূলত একটি মার্কিন প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।

মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধবিরতিতে কাতারের ভূমিকা হলো হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সরাসরি আলোচনার সুযোগ তৈরি করা। অন্যদিকে, মিশর ও আমেরিকার মধ্যস্থতা ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি এবং উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আলোচনায় সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

মার্কিন প্রস্তাবে কী আছে?

প্রস্তাবটি মূলত তিন ধাপে বাস্তবায়নের কথা বলছে:

  1. প্রথম ধাপ (৬ সপ্তাহ): এই পর্যায়ে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। হামাস নারী, শিশু, বয়স্ক এবং অসুস্থ জিম্মিদের মুক্তি দেবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল শত শত ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। একই সাথে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার জনবহুল এলাকা থেকে সরে আসবে এবং প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী ট্রাককে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেবে।
  2. দ্বিতীয় ধাপ: এই ধাপে হামাসের হাতে থাকা বাকি সব জীবিত জিম্মি, বিশেষ করে পুরুষ সেনাসদস্যদের মুক্তি দেওয়া হবে। এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের দ্বিতীয় একটি বড় দলকে মুক্তি দেওয়া হবে। এই পর্বেই ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে।
  3. তৃতীয় ধাপ: গাজার দীর্ঘমেয়াদী পুনর্গঠনের কাজ শুরু হবে এবং নিহত জিম্মিদের দেহাবশেষ বিনিময় করা হবে।

জিম্মি ও বন্দি বিনিময়ের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ইসরায়েলি জিম্মির বিনিময়ে কতজন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে, তা নিয়েই চলছে মূল দর কষাকষি।

দুই পক্ষের অবস্থান ও মূল মতপার্থক্য

আলোচনার টেবিলে প্রস্তাব থাকলেও দুই পক্ষের অনড় অবস্থানই শান্তির পথে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হামাসের দৃষ্টিভঙ্গি

হামাসের দাবিগুলো কী কী? তাদের কাছে এই যুদ্ধ শুধু জিম্মি বিনিময়ের বিষয় নয়, এটি তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাদের প্রধান দাবিগুলো হলো:

  • স্থায়ী যুদ্ধবিরতি: হামাস একটি স্থায়ী ও টেকসই যুদ্ধবিরতি চায়, যার মাধ্যমে যুদ্ধের সম্পূর্ণ সমাপ্তি ঘোষিত হবে।
  • সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার: গাজা থেকে সমস্ত ইসরায়েলি সেনার নিঃশর্ত প্রত্যাহার।
  • অবরোধ মুক্তি: গাজার উপর থেকে দীর্ঘদিনের অবরোধ সম্পূর্ণ তুলে নেওয়া।
হামাসের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট। তারা মনে করে, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা ছাড়া যেকোনো চুক্তিই ইসরায়েলকে পুনরায় আক্রমণ করার সুযোগ করে দেবে।

ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসরায়েল কি সব শর্তে রাজি? উত্তরটি হলো, 'না'। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার হামাসের মূল দাবিগুলো মানতে নারাজ।

  • হামাস নির্মূল: নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা হলো হামাসের সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। এর আগে যুদ্ধ থামানোর কোনো প্রশ্নই আসে না।
  • অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি: ইসরায়েল শুধুমাত্র একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী, যার মূল উদ্দেশ্য জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা।
  • নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ: যুদ্ধ শেষ হলেও গাজার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েল নিজেদের হাতে রাখতে চায়।
সুতরাং, মূল বাধা এখানেই। হামাস চাইছে যুদ্ধের সমাপ্তি, আর ইসরায়েল চাইছে হামাসের সমাপ্তি। এই দুই বিপরীতমুখী লক্ষ্যের মধ্যে কোনো সাধারণ পথ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

ভবিষ্যৎ ও বিশ্লেষণ

এই জটিল পরিস্থিতিতে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে চলে আসে।

যুদ্ধবিরতি কি সফল হবে?

অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে, সম্ভাবনা খুবই কম। নেতানিয়াহু তার কট্টরপন্থী জোট সরকারের চাপে রয়েছেন। যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলে তার সরকারের পতন হতে পারে। অন্যদিকে, হামাসও তাদের মূল দাবি থেকে সরে আসতে রাজি নয়। তাই আলোচনা দীর্ঘায়িত হতে পারে, কিন্তু একটি সফল চুক্তিতে পৌঁছানো কঠিন।

যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হলে কী হবে?

এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ইসরায়েল গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহ-তে পূর্ণমাত্রায় অভিযান শুরু করতে পারে, যেখানে ১০ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে। এটি একটি ভয়াবহ গণহত্যার জন্ম দিতে পারে। একই সাথে, এই সংঘাত লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়বে, যা পুরো অঞ্চলকে একটি বড় যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।

গাজার ভবিষ্যৎ কী? এবং স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা কতটা?

যুদ্ধবিরতি হলেও গাজার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া শহরের পুনর্গঠন এবং ২২ লক্ষ মানুষের পুনর্বাসন এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিকভাবে, "গাজার পরের দিন" কী হবে, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ। যতদিন ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবি পূরণ না হচ্ছে, ততদিন এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের চক্র চলতেই থাকবে। দুই-রাষ্ট্র সমাধান আজ একটি কথার কথা মাত্র।

উপসংহার: অসমাপ্ত পথের গল্প

শেষ পর্যন্ত, গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনার ভাগ্য ঝুলে আছে দুই পক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। দোহা, কায়রো বা ওয়াশিংটনের আলোচনায় ব্যবহৃত শব্দগুলোর চেয়ে গাজার মাটিতে চলা বন্দুকের শব্দ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। আমরা একটি সারসংক্ষেপে পৌঁছাতে পারি যে, আলোচনার টেবিলে প্রস্তাব আছে, মধ্যস্থতাকারী আছে, কিন্তু বিশ্বাস এবং ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নেই।

যতক্ষণ না দুই পক্ষ তাদের সর্বোচ্চ দাবি থেকে সরে এসে মানবিকতাকে প্রথম স্থান দিচ্ছে, যতক্ষণ না দখলদারিত্বের মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে, ততক্ষণ কূটনৈতিক আলোচনা হয়তো চলবে, কিন্তু গাজার আকাশে শান্তির পায়রা উড়বে না। এটি একটি অসমাপ্ত পথের গল্প, যার প্রতিটি মোড়ে লেখা আছে রক্ত আর দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস।