ডলারের রাজত্ব কি শেষ? ডি-ডলারাইজেশন, ব্রিকস ও বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ
মার্কিন ডলারের আধিপত্য কি শেষ হতে চলেছে? জানুন ডি-ডলারাইজেশন কী, কেন চীন-রাশিয়া ও ব্রিকস জোট ডলার ছাড়তে চাইছে এবং বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে। একটি সহজ বিশ্লেষণ।

ভূমিকা
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসে আপনি এই লেখাটি পড়ছেন, আপনার হাতে থাকা ফোন, আপনার গাড়ির জ্বালানি, এমনকি আপনার পরা পোশাক—এর কোনো না কোনোটির আন্তর্জাতিক মূল্য মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হয়েছে। প্রায় আশি বছর ধরে মার্কিন ডলার বিশ্ব অর্থনীতির ‘রাজা’ হিসেবে কাজ করছে। এটি কেবল একটি মুদ্রা নয়, এটি বিশ্ব বাণিজ্য ও ক্ষমতার একটি প্রতীক।
কিন্তু সম্প্রতি এই ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার মতো বিশ্বের বড় শক্তিগুলো এখন ডলারের এই একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তারা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে যেখানে ডলারের ভূমিকা কমে আসবে। এই প্রক্রিয়াটির নাম দেওয়া হয়েছে ডি-ডলারাইজেশন (De-dollarization)।
এই আলোচনাটি এখন আর শুধু অর্থনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি ভূ-রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ ডলারের আধিপত্য কমা বা বাড়ার সঙ্গে শুধু আমেরিকার অর্থনীতিই নয়, বরং পুরো বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য জড়িত। এই প্রতিবেদনে আমরা সহজ বাংলায় বোঝার চেষ্টা করব ডলার কীভাবে বিশ্বের রাজা হয়ে উঠল, কেন দেশগুলো এখন ডলার ছাড়তে চাইছে, এর বিকল্প কী হতে পারে এবং এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নিতে পারে।
ডলার কীভাবে বিশ্বের রাজা হয়ে উঠলো?
ডলারের আধিপত্য কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার ফল। এর পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে।
ঐতিহাসিক ভিত্তি: ব্রেটন উডস চুক্তি
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন বিশ্বের ৪৪টি মিত্র দেশ আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস নামক স্থানে একত্রিত হয়। যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। দেশগুলো নিজেদের মুদ্রার মান ইচ্ছামতো কমাচ্ছিল, যা বাণিজ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে একটি নতুন ও স্থিতিশীল আর্থিক ব্যবস্থা তৈরির জন্য ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ।
সেই সময় আমেরিকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি। যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেলেও আমেরিকার শিল্প ও পরিকাঠামো অক্ষত ছিল। বিশ্বের মোট সোনার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আমেরিকার হাতে ছিল । এই শক্তির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, মার্কিন ডলারই হবে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। ডলারকে সোনার সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট হারে ($35 প্রতি আউন্স) যুক্ত করা হয় এবং অন্য সব দেশের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে যুক্ত করা হয় । এর ফলে ডলার বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা বা রিজার্ভ কারেন্সি হয়ে ওঠে।
নিক্সন শক এবং পেট্রোডলার ব্যবস্থা
১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ খরচের কারণে আমেরিকার অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। দেশগুলো তাদের হাতে থাকা ডলারের বিনিময়ে সোনা চাইতে শুরু করে, যা আমেরিকার সোনার রিজার্ভ দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছিল । এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এক ঘোষণায় ডলারের সঙ্গে সোনার সম্পর্ক ছিন্ন করেন ।
যুক্তি অনুযায়ী, এর ফলে ডলারের পতন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টো। আমেরিকা একটি যুগান্তকারী কূটনৈতিক চাল দেয়। ১৯৭০-এর দশকে সৌদি আরব এবং ওপেক (OPEC) ভুক্ত অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকা চুক্তি করে যে, বিশ্বের সমস্ত তেল কেনাবেচা শুধুমাত্র মার্কিন ডলারে করতে হবে । এই ব্যবস্থাকেই পেট্রোডলার সিস্টেম বলা হয়। যেহেতু বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেরই তেল প্রয়োজন, তাই তেল কেনার জন্য তাদের হাতে ডলার রাখতেই হতো। এটি সোনার সমর্থন ছাড়াই ডলারের জন্য এক বিশাল এবং কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে, যা ডলারের রাজত্বকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
কেনো ডলার এত শক্তিশালি?
আজকের দিনে ডলারের আধিপত্য কয়েকটি শক্তিশালী স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে:
বিশাল অর্থনীতি:, আমেরিকা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজার। বিশ্বের বেশিরভাগ পণ্যই আমেরিকার বাজারে বিক্রি হওয়ার জন্য তৈরি হয়, যা ডলারকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বাভাবিক মুদ্রায় পরিণত করেছে ।
গভীর আর্থিক বাজার:, এটিই ডলারের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমেরিকার ট্রেজারি বন্ডের বাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড়, নিরাপদ এবং তরল বাজার । যখনই বিশ্বে কোনো সংকট দেখা দেয়, বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ সুরক্ষিত রাখতে আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড কেনেন। একে বলা হয় "নিরাপদ আশ্রয়" (safe haven)। এই কারণে সংকটের সময়েও ডলার আরও শক্তিশালী হয় ।
প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস:, আমেরিকার প্রতিষ্ঠান, যেমন এর স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেডারেল রিজার্ভ), এর ওপর বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের আস্থা রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে যে তাদের বিনিয়োগ আমেরিকায় সুরক্ষিত থাকবে ।
নেটওয়ার্ক প্রভাব:, ডলারের ব্যবহার অনেকটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো। সবাই ডলার ব্যবহার করে, কারণ বাকি সবাই এটাই ব্যবহার করে। ভিয়েতনামের একজন রপ্তানিকারকের জন্য ব্রাজিলের একজন আমদানিকারকের কাছে পণ্য বিক্রি করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ডলারে লেনদেন করা। অন্য কোনো মুদ্রায় এটি করতে গেলে খরচ ও ঝুঁকি দুটোই বেড়ে যায় । এই নেটওয়ার্ক প্রভাবের কারণে ডলারের বিকল্প তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন।
এই স্তম্ভগুলো একটি স্ব-শক্তিশালী চক্র তৈরি করেছে। ডলারের চাহিদা আমেরিকার সরকারকে সস্তায় ঋণ নিতে সাহায্য করে, যা দিয়ে তারা তাদের বিশাল সামরিক বাজেট পরিচালনা করে। এই সামরিক শক্তি, ঘুরে, বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য পথ সুরক্ষিত রাখে এবং আমেরিকার সম্পদকে নিরাপদ মনে করতে সাহায্য করে, যা আবার ডলারের প্রতি আস্থা বাড়ায়। এই চক্র ভাঙা যেকোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।
‘ডি-ডলারাইজেশন’ কী এবং কেন দেশগুলো ডলার ছাড়তে চাইছে?
ডি-ডলারাইজেশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে মার্কিন ডলারের ওপর তাদের নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতাটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণ: ডলার যখন অস্ত্র (আর্থিক নিষেধাজ্ঞা) ডি-ডলারাইজেশনের সবচেয়ে বড় এবং জরুরি কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে একটি ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা। বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় সমস্ত লেনদেন যেহেতু ডলারের মাধ্যমে হয়, তাই আমেরিকা চাইলেই যেকোনো দেশকে এই ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এই ক্ষমতাকে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা (Financial Sanctions) বলা হয় ।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় $300 বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করার ঘটনা । এটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর আগে নিষেধাজ্ঞা সাধারণত নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর আরোপ করা হতো। কিন্তু একটি দেশের সার্বভৌম সম্পদ এভাবে জব্দ করা হবে, তা অনেকেই ভাবতে পারেনি। এই ঘটনাটি বিশ্বের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে চীনকে একটি কঠোর বার্তা দিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে আমেরিকার সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা দিলে তাদের ট্রিলিয়ন ডলারের রিজার্ভও নিরাপদ নয়। এই ঘটনা ডি-ডলারাইজেশনকে একটি তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে প্রতিটি দেশের জন্য একটি জরুরি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত করেছে। আমেরিকা তার ডলারের ক্ষমতাকে স্বল্পমেয়াদী ভূ-রাজনৈতিক লাভের জন্য যত বেশি ব্যবহার করছে, দীর্ঘমেয়াদে ডলারের প্রতি বিশ্বের আস্থা ততটাই ক্ষয় হচ্ছে। এটি অন্য দেশগুলোকে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরিতে উৎসাহিত করছে।
দ্বিতীয় কারণ: অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। যখন আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেডারেল রিজার্ভ) সুদের হার বাড়ায়, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পুঁজি আমেরিকায় চলে যায়। এর ফলে সেই দেশগুলোতে আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে । নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য করলে দেশগুলো আমেরিকার মুদ্রানীতির এই ধরনের প্রভাব থেকে নিজেদের অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব বাড়াতে পারে।
তৃতীয় কারণ: পরিবর্তনশীল বিশ্ব ব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৫০% নিয়ন্ত্রণ করত । আজ সেই অংশ কমে প্রায় ২৫% এ দাঁড়িয়েছে । অন্যদিকে, চীন, ভারত এবং অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির অংশীদারিত্ব নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ডি-ডলারাইজেশনের সমর্থকরা মনে করেন যে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাটিও এই নতুন বহুমাত্রিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করা উচিত, যেখানে ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে ।
ডলারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে কারা?
ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার এই আন্দোলনে কয়েকটি দেশ ও জোট প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তাদের লক্ষ্য ডলারকে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া নয়, বরং ধীরে ধীরে এর প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা।
চীন-রাশিয়া অক্ষ
এই আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ডলার ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে, চীন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এবং বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে একটি বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করছে।
এই দুটি দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ডলারের ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে তাদের মধ্যে বাণিজ্যের ৯০% এরও বেশি চীনের মুদ্রা ইউয়ান এবং রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে নিষ্পত্তি হয় । চীন সুইফট (SWIFT) ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে নিজস্ব ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (CIPS) তৈরি করেছে । যদিও এটি এখনও সুইফটের তুলনায় অনেক ছোট, তবে এটি দ্রুতগতিতে বাড়ছে এবং নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া দেশগুলোর জন্য একটি বিকল্প পথ খুলে দিচ্ছে।
ব্রিকস+ জোট
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জোট ব্রিকস (BRICS) ডি-ডলারাইজেশন এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রধান রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান এবং মিশরের মতো প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো এই জোটে যোগ দেওয়ায় এর অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে ।
ব্রিকসের লক্ষ্য হলো সদস্য দেশগুলোর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়ানো এবং ডলার-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমানো। এই লক্ষ্যে তারা নিজস্ব নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB) প্রতিষ্ঠা করেছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ প্রদান করে । এমনকি একটি সাধারণ ব্রিকস মুদ্রা তৈরির আলোচনাও চলছে, যদিও এর বাস্তবায়ন এখনও অনেক দূরের পথ ।
সোনার প্রত্যাবর্তন
এই ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আবারও সোনার দিকে ঝুঁকছে। চীন, রাশিয়া, তুরস্ক এবং ভারতের মতো দেশগুলো রেকর্ড পরিমাণে সোনা কিনছে । এর কারণ সোনা একটি ভৌত সম্পদ যা নিজ দেশের ভল্টে রাখা যায়। এটিকে কোনো বিদেশি রাষ্ট্র চাইলেই জব্দ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে না । এটি ডলারের ওপর আস্থার ক্ষয় এবং একটি নিষেধাজ্ঞা-মুক্ত নিরাপদ সম্পদের সন্ধানের স্পষ্ট ইঙ্গিত।
এই সমস্ত উদ্যোগ মিলে একটি একক বিকল্প তৈরি করছে না, বরং অনেকগুলো সমান্তরাল "পালাবার পথ" তৈরি করছে। এর মূল উদ্দেশ্য ডলারকে প্রতিস্থাপন করা নয়, বরং ডলারকে কম অপরিহার্য করে তোলা, যাতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানো যায়।
ডলারের বিকল্প কি সত্যিই আছে?
ডলারের আধিপত্য কমার জন্য একটি বা একাধিক বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প উঠে আসা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে ডলারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, যেমন ইউরো এবং চীনা ইউয়ান, উভয়েরই কিছু মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী ১: ইউরো (€) ইউরো নিঃসন্দেহে বিশ্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা। এটি একটি বিশাল এবং উন্নত অর্থনৈতিক ব্লকের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এর একটি বিশ্বাসযোগ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক রয়েছে । কিন্তু এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো একটি একীভূত নিরাপদ সম্পদের অভাব। আমেরিকায় যেমন মার্কিন ট্রেজারি বন্ড রয়েছে, ইউরোজোনে তেমন কোনো একক "ইউরোবন্ড" নেই । ইউরোপের ঋণ বাজার জার্মানির বন্ড, ফ্রান্সের বন্ড, ইতালির বন্ড ইত্যাদিতে বিভক্ত, যার প্রত্যেকটির ঝুঁকি ভিন্ন। একটি মুদ্রা ইউনিয়ন থাকলেও এর পেছনে কোনো একক রাজনৈতিক বা রাজস্ব ইউনিয়ন না থাকায় ইউরো ডলারের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে ।
প্রতিদ্বন্দ্বী ২: চীনা ইউয়ান (¥) চীনের বিশাল অর্থনীতির কারণে ইউয়ান একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী। চীন সরকার সক্রিয়ভাবে এর আন্তর্জাতিক ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে । কিন্তু ইউয়ানের সবচেয়ে বড় বাধা হলো বিশ্বাস এবং নিয়ন্ত্রণের অভাব। চীনে পুঁজির প্রবাহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, অর্থাৎ অর্থ অবাধে দেশের ভেতরে-বাইরে যেতে পারে না । কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বড় বিনিয়োগকারী এমন একটি মুদ্রাকে তাদের প্রধান রিজার্ভ হিসেবে বেছে নেবে না, যেখানে তারা এই ভয়ে থাকবে যে চীন সরকার সংকটের সময় তাদের অর্থ আটকে দিতে পারে। আইনের শাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি ইউয়ানের বিশ্ব মুদ্রা হয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা ।
প্রধান মুদ্রাগুলোর একটি সহজ তুলনা নিচের সারণীটি ডলার, ইউরো এবং ইউয়ানের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে, যা থেকে বোঝা যায় কেন ডলার এখনও শীর্ষে রয়েছে।
বৈশিষ্ট্য | মার্কিন ডলার (USD) | ইউরো (EUR) | চীনা ইউয়ান (CNY) |
---|---|---|---|
বিশ্ব রিজার্ভের শেয়ার | ~৫৮% (অনেক বেশি) | ~২০% (মাঝারি) | ~৩% (খুব কম) |
বিশ্ব বাণিজ্যে ব্যবহার | খুব বেশি | মাঝারি | কম |
একক নিরাপদ সম্পদ | ✔ | ✘ | ✘ |
অবাধ রূপান্তরযোগ্যতা | ✔ | ✔ | ✘ |
প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস | উচ্চ | উচ্চ | কম |
ভবিষ্যৎ কী? তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডলারের আকস্মিক পতন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। পরিবর্তন যা হবে, তা হবে ধীর এবং বিবর্তনমূলক। ভবিষ্যতের জন্য তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি কল্পনা করা যেতে পারে।
পরিস্থিতি ১: ডলারের আধিপত্য বজায় থাকা (স্থিতিশীল আধিপত্য) এটিই নিকট ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিস্থিতি। আগামী ১০-২০ বছরে ডলারের কাঠামোগত সুবিধাগুলো (যেমন, গভীর আর্থিক বাজার, নেটওয়ার্ক প্রভাব) এতটাই শক্তিশালী থাকবে যে কোনো বিকল্প এর জায়গা নিতে পারবে না। ডি-ডলারাইজেশন প্রচেষ্টা চলবে, কিন্তু তা মূলত কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ডলার ব্যবস্থার দক্ষতা এবং নিরাপত্তার ওপরই আস্থা রাখবে ।
পরিস্থিতি ২: মুদ্রা ব্লকের বিশ্ব (বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা) এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব ধীরে ধীরে কয়েকটি মুদ্রা ব্লকে বিভক্ত হয়ে পড়বে। একটি ডলার ব্লক (আমেরিকা ও তার মিত্র দেশ), একটি ইউরো ব্লক (ইউরোপ ও আফ্রিকা) এবং একটি ইউয়ান ব্লক (এশিয়া ও চীনের মিত্র দেশ) তৈরি হতে পারে । ডলার তখনও হয়তো "সমানদের মধ্যে প্রথম" থাকবে, কিন্তু এটি আর একমাত্র বিকল্প থাকবে না। এই ব্যবস্থাটি আরও প্রতিযোগিতামূলক হলেও অস্থিতিশীল হওয়ার ঝুঁকিও থাকবে, কারণ মুদ্রা ব্লকগুলোর মধ্যে পুঁজির প্রবাহ দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে ।
পরিস্থিতি ৩: ডলারের ধীরগতির ক্ষয় এই পরিস্থিতিতে ডলারের কোনো নাটকীয় পতন হবে না, কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য ও রিজার্ভে এর অংশীদারিত্ব বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। বিশ্ব একটি একক মুদ্রা থেকে সরে গিয়ে বিভিন্ন মুদ্রার একটি বৈচিত্র্যময় ঝুড়ির দিকে ঝুঁকবে। এটি কোনো বিপ্লব নয়, বরং প্রভাবের একটি ধীরগতির ক্ষয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ডলারের ভবিষ্যৎ যতটা না চীন বা রাশিয়ার কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভর করে আমেরিকার নিজের নীতির ওপর। আমেরিকার ক্রমবর্ধমান জাতীয় ঋণ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নিষেধাজ্ঞার অতিরিক্ত ব্যবহার যদি বিশ্বজুড়ে আস্থা কমাতে থাকে, তবে ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হবে ।
শেষ কথা
আমরা বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগ হয়তো শেষ হচ্ছে না, কিন্তু এর প্রশ্নাতীত রাজত্ব যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা অনস্বীকার্য। ডলারের পতন রাতারাতি হবে না, কারণ এর ভিত্তি এখনও অনেক গভীরে এবং এর কোনো যোগ্য বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি।
তবে, আমরা একটি ধীর কিন্তু নিশ্চিত পরিবর্তনের সাক্ষী হচ্ছি। বিশ্ব একটি একমেরু আর্থিক ব্যবস্থা থেকে একটি বহুমাত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে। এই যাত্রাপথটি কেমন হবে—শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল, নাকি সংঘাতময় ও বিশৃঙ্খল—তা নির্ভর করবে বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোর আগামী কয়েক দশকের সিদ্ধান্তের ওপর। ডলারের দীর্ঘ রাজত্ব হয়তো শেষ হয়নি, তবে এর একচ্ছত্র ক্ষমতার গোধূলি যে শুরু হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।